রিক্সা চালক যখন ডাক্তার – ইন্জিনিয়ার’র বাবা


hudhudbd.com
বাংলা চ্যানেল
প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল, ২০২১

প্রফেসর ড. আ ক ম আব্দুল কাদের
আমি একজন রক্ষণশীল পরিবারে লালিত পালিত হওয়ার কারণে আমার ছেলে মেয়েকেও একই ভাবধারায় বড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এতে আমি কতটুকু সফল আর কতটুকু বিফল তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। তবে এ ক্ষেত্রে আমার আন্তরিকতা নিখাদ। সহশিক্ষা ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই আমার বাসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হওয়া সত্ত্বেও এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র ব্যয়ে পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন পর্যন্ত না করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আমি আমার মেয়েকে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করিয়েছি এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে অবস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এতে আমার কোন কোন বন্ধু আমাকে নির্বোধদের তালিকায় ফেলতেও দ্বিধা করে নি।
মেয়েটি সাপ্তাহিক কিংবা অন্যান্য ছুটির দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাদের বাসায় চলে অসতো এবং ছুটি শেষে আবার তার হলে চলে যেতো। এ ক্ষেত্রে আমি অথবা আমার স্ত্রী তার আসা যাওয়ার পথে সঙ্গী হতাম।
২০১৪ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি শেষে খোলার দিন আমি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি বহর্দার হাট বাস টার্মিনাল সংলগ্ন তার আবাসিক হলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে আমরা বাবা মেয়ে মিলে ষোলশহর দুই নম্বর পর্যন্ত গেলাম। তারপর যেতে হবে রিক্সায় চড়ে। এখান থেকে তার হলে যেতে সাধারণত রিক্সা ভাড়া চল্লিশ টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নেমে আমি একজন মধ্য বয়স্ক রিক্সা চালকের সাথে ভাড়া নিয়ে আলাপ করছিলাম। সে ত্রিশ টাকা চাওয়াতে কোন বাক্য ব্যয় না করে বাবা মেয়ে তাতে উঠে পড়লাম, আর মনে মনে ভাবলাম নতুন ড্রাইভার, হয়ত ভাড়ার রেট জানে না। যাক, অন্তত দশ টাকা সাশ্রয় হলো। কিন্তু আমি তখনো জানি না আমার জন্য বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছে।
আমার একটা বদ অভ্যাস হলো, আমি কোন ট্রান্সপোর্টে উঠলে তার সাথে পাইকারি খুচরা সব আলাপ শেষ করে ফেলি। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী আলাপ শুরু করলাম। প্রথমে জানতে চাইলাম তার দৈনিক আয় কত? জবাবে সে বললো, আমি তো নিয়মিত রিক্সা চালক না, তাই এর কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নাই। জিজ্ঞেস করলাম, তা হলে আপনি কি করেন? বললো, সরকারি চাকরি করি। বললাম: কোথায়? জবাব দিল, আমীন জুট মিলে প্রোডাকশন সুপারভাইজার হিসাবে। বললাম: বেতন কত? বললো: পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। আরো কিছু ওভার টাইম ভাতা পাই। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তা হলে রিক্সা চালাচ্ছেন কেন ? বললো: সন্তানের সেফটির জন্য। আমি বুঝতে পারি নি। তাই ব্যাখ্যা করতে বললাম। তখন সে যে ব্যাখ্যা দিল তার সার সংক্ষেপ হলো-
তার তিন ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটি নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষ অনার্স এর ছাত্রী। নিজে রিক্সা চালিয়ে সকালে মেয়েকে দিয়ে আসে এবং ছুটির পর আবার বিকেলে নিয়ে আসে। এতে তার দৈনিক এক শ বিশ টাকা সাশ্রয় হয়। আবার আনা নেয়ার জন্য খালি না গিয়ে যাত্রী নিয়ে যায়। এতে আরো কমপক্ষে এক শ বিশ টাকা আয় হয়। তা ছাড়া মেয়েটি নিজে আনা নেয়ার করার কারণে কোন ছেলে বন্ধু জোটানোর সুযোগও পায় না।
এরপর আসে ছেলেদের কথা। বড় ছেলে ঢাকা মেডিকেলে পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। মেঝো ছেলে বুয়েটে তৃতীয় বর্ষে, আর ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। থাকে লক্ষীপুর। সে আমাকে আরও জ্ঞান দিল এই বলে, স্যার আপনি হয়ত জানেন না। মেডিক্যালের একটা বই এর দাম পনেরো বিশ হাজার টাকা। এত টাকা যোগাড় করা সম্ভব নয় বিধায় নীল ক্ষেত থেকে কপি করা বই কিনে দিতে হয় অল্প দামে। আমি বললাম: ডাক্তার ইন্জিনিয়ার ছেলে রিক্সা চালাতে নিষেধ করে না? বললো, প্রথম প্রথম তারা তীব্র বিরোধিতা করেছে। যখন আমি তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হলাম, আমি রিক্সা চালিয়ে মেয়েকে কলেজে নিয়ে না গেলে তোরা তোদের বোনকে হারাবি আর আমি হারাবো আমার মেয়েকে। তখন তারা আর প্রতিবাদ করে নি। বরং বড় ছেলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে প্র্যাকটিস করে প্রথম কাজ হবে একটা গাড়ি কেনা যা দিয়ে বাবা তার মেয়েকে নিয়ে কলেজে যাবে।এই কথা বলে সে একটা তৃপ্তির হাসি দিল। আমার মনে হলো এই হাসি থেকে যেন স্বর্গীয় দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। রিক্সা থেকে নেমে তাকে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে তার সাথে কোলাকুলি করলাম। আর আমার মেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সমস্ত দৃশ্য অবলোকন করলো।
এখান থেকে যে শিক্ষাটি পেলাম তা হলো, সমাজের প্রতিটি মানুষের কিছু সামাজিক মর্যাদা রয়েছে যা হয়ত আমরা জানি না। তাই মানুষের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, তিনি যে পেশারই হোন না কেন । আরো শিক্ষা পেলাম, মা- বাবা যদি সচেতন এবং দায়িত্বশীল হন তা হলে আমাদের সন্তানরা কখনো বখে যাবে না।

শেয়ার করুন

Facebook Twitter Whatsapp

বিজ্ঞাপন
ফেসবুকে বাংলা চ্যানেল
এ সম্পর্কিত আরও খবর

নিউজ কর্নার
Banglachannel বাংলা চ্যানেল

সম্পাদক : সাইফুল্লাহ মুসলিম
বিএ টাওয়ার ৫ম তলা, দেওয়ানহাট
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ ।

বাংলা চ্যানেল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত