প্রফেসর ড. আহমদ আলী
আমার জানা মতে, বাংলাদেশের আলিমগণ প্রধানত ছয়টি ধারায় বিভক্ত:
ক. দেওবন্দী ধারা
এটি বাংলাদেশের আলিমগণের বৃহত্তর ধারা। এ ধারার আলিমগণ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা আকীদায় আশ‘আরী ও মাতুরিদী চিন্তাধারার অনুসারী, ইলমুল কালাম (যুক্তিমিশ্রিত ও ব্যাখ্যানির্ভর ধর্মতত্ত্ব)-এর সমর্থক; ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ ও তাসাউফের অনুবর্তী। একসময় বাংলাদেশে এ ধারার আলিমগণ প্রায়ই প্রচলিত ধারায় রাজনীতিবিমুখ ছিলেন, এমনকি তাদের কেউ কেউ প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধে ফাতওয়াও দিতেন। এখনও তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ রাজনীতিবিমুখ। তারা সাধারণত গণতন্ত্র চর্চার বিরোধী। এখন অবশ্যই তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ প্রচলিত রাজনীতির সাথে জড়িত এবং গণতন্ত্র চর্চায়ও অংশগ্রহণ করেন।
নদভী ধারা
দেওবন্দী ধারার একটি উল্লেখযোগ্য উপধারা হলো নদভী ধারা। এ ধারার প্রাণপুরুষ হলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও চিন্তাবিদ ভারতের লখনৌস্থ ‘দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা’র মহাপরিচালক সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী [১৯১৩-১৯৯৯ খ্রি.] (রাহ.)। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ-এর মজলিসে শূরার স্থায়ী সদস্যও ছিলেন। এ উপধারার আলিমগণ নিজেদেরকে দেওবন্দী মতাদর্শের ধারক মনে করলেও দেওবন্দী আলিমগণ কিন্তু তাদেরকে নিজেদের একান্ত অনুসারীরূপে গণ্য করেন না এবং তাদেরকে অনেকটা দেওবন্দী-আদর্শচ্যুত মনে করেন। চিন্তাধারা ও মনমাসকিতাগত দিক থেকে দেওবন্দীদের সাথে নদভীদের পার্থক্যটা লক্ষণীয়। নদভীগণ তুলনামূলকভাবে অধিকতর উদার মনোভাবাপন্ন ও সংস্কারমনা। এ ধারাটি ভারতের লখনৌস্থ ‘দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা’র চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত। উল্লেখ্য যে, ১৮৯৪ সালে অপেক্ষাকৃত আধুনিক চিন্তাধারার সাথে ইসলামী ফিকহ ও গবেষণাকে সমন্বয়ের ব্রত নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব দেওবন্দ ধারা থেকে নাদওয়াতুল উলামাকে একটি সংস্কারপন্থী প্রগতিশীল বলে জানে। এমনকি দু ধারার ড্রেস কোড পর্যন্ত আলাদা। মুসলিম বিশ্ব দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওবন্দ স্কুল অব থট ও নাদওয়াতুল উলামা স্কুল অব থট বলে জানে। বাংলাদেশে এ ধারায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধতম হলো চট্টগ্রামের জামেয়া দারুল মা‘আরিফ।
খ. সালাফী ধারা। এ ধারার আলিমগণ আকীদায় আছারী (ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত) চিন্তাধারার অনুসারী, ইলমুল কালামকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ফিকহের ক্ষেত্রে তাঁদের ধারণা মতে তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো মাযহাবের অনুসরণের পরিবর্তে সহীহ হাদীসসমূহের অনুসরণ করেন; তাসাউফের কট্টর বিরোধী ও সমালোচক। বাংলাদেশে এ ধারার আলিমগণ (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) প্রায়ই রাজনীতিবিমুখ। অধিকন্তু তাঁরা গণতন্ত্রকে একটি কুফরী মতবাদ হিসেবে জানেন।
গ. বেরেলভী ধারা। এ ধারার আলিমগণ মুফতী আহমদ রেযা খান বেরেলভী (রাহ.)-এর চিন্তাধারার অনুসারী এবং ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ। এরা তাসাউফের কট্টর সমর্থক ও অনুবর্তী। এরা নবী-রাসূল ও ওলী-আল্লাহগণ সম্পর্কে এমন কিছু চিন্তা-বিশ্বাস পোষণ করেন, যা অন্য ধারার আলিমগণ অতিরঞ্জন বা শিরক বলে গণ্য করেন। এ ধারার আলিমগণ সাধারণত রাজনীতিমুখী নন; যদিও তারা অনেক সময় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন।
ঘ. সূফী ধারা। এ ধারার আলিমগণ ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ ও প্রায়ই রাজনীতিবিমুখ। তাসাউফ চর্চার ক্ষেত্রে তাঁরা দুটি উপধারায় বিভক্ত:
ঘ.১. দর্শননির্ভর সুফী ধারা। এ ধারার আলিমগণ বাতিনী চিন্তার অনুসারী। তাদের মতে, শরী‘আত ও তরীকত দুটি ভিন্ন বিষয়। এরা তরীকত ও মারিফতের নামে এমন অনেক চিন্তা (যেমন ইত্তিহাদ, ওয়াহদাতুল ওয়াজূদ, হুলূল, ফানা, বকা, তানাসুখুল আরওয়াহ, ওয়াহদাতুল আদয়ান, ইসকাতুত তাকালীফ প্রভৃতি) পোষণ করে এবং কাজ করে, যা প্রকাশ্যত ইসলামের আকীদা ও বিধিবদ্ধ রীতিনীতির পরিপন্থী।
ঘ.২. শরী‘আতনির্ভর সুফী ধারা। এ ধারার আলিমগণ আকীদায় আশ‘আরী ও মাতুরিদী চিন্তাধারার অনুসারী। তাঁদের মতে, শরী‘আত ও তরীকত দীনের পরস্পর অবিচ্ছেদ্য দুটি অংশ। শরী‘আত হলো দীনের বাহ্যিক অর্থাৎ কর্মমুখী ও ব্যবহারিক রূপ আর তরীকত হলো আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে অনুসৃত পথ। এ ধারার অনুসারী আলিমগণ তরীকতের নির্দিষ্ট আমলগুলোর পাশাপাশি শরী‘আতের বিধিবিধান পালনের প্রতিও তাগাদা দেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাতিনী সূফীদের উপর্যুক্ত চিন্তাগুলো রদ করেন, আবার কেউ কেউ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন।
ঙ. মিশ্র ধারা। মিশ্র ধারা বলতে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী আলিমগণকে বোঝানো হয়েছে। এ ধারার মধ্যে বিভিন্ন ধারার আলিমগণের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এখানে বেশির ভাগ আলিম আলিয়া ধারায় শিক্ষিত হলেও দেওবন্দী ও সালাফী ধারায় শিক্ষিত অনেক আলিমও রয়েছেন। উল্লেখ্য যে, এখানে আকীদার ক্ষেত্রে যেমন আছারী আকীদার অনুসারী আলিমগণ রয়েছেন, তেমনি আশ‘আরী ও মাতুরিদী চিন্তাধারার অনুসারী আলিমগণও রয়েছেন; তবে কিছু বিষয়ে সকলেই মাওলানা সাইয়িদ আবুল আলা মাওদূদী (রাহ.)-এর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত। আর ফিকহের ক্ষেত্রে এখানে বেশিরভাগ আলিম হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ, তবে অল্প কিছু সংখ্যক আলিম সালাফী চিন্তাধারার অনুসারী। এ ধারার আলিমগণ সকলেই রাজনীতিমুখী। তাদের মতে, ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি দুটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এরা প্রচলিত নিয়ম-কানুন মেনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। তাসাউফের ক্ষেত্রেও এ ধারার মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার আলিমগণ রয়েছেন। তবে তাদের অধিকাংশ আলিমই প্রচলিত তাসাউফে বিশ্বাসী নন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মূলত একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এটি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মতাত্ত্বিক দল নয়; যদিও এর কিছু চিন্তা-বিশ্বাস নিয়ে অন্যান্য ধারার আলিমগণের সাথে মতপার্থক্য রয়েছে।
চ. জিহাদী ধারা। এটি বাংলাদেশের আলিমগণের একটি ক্ষুদ্রতম ধারা। এ ধারার আলিমগণ মনে করেন, প্রচলিত ধারায় গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা আদৌ সম্ভব নয়। তাদের মতে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হলো- সশস্ত্র জিহাদ বা বিপ্লব।
উল্লেখ্য যে, এ ছয়টি ধারার আলিমগণ আবার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা কারণে বহু দল-উপদল ও গ্রুপে বিভক্ত। চলবে…