(ক) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর(রা:)’র ‘শাসনামলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০ রাকা’ত তারাবীহ’র নামাজ আদায় করা হতো। তিনিই জামায়াতবদ্ধ তারাবীহ’র নামাজ আদায়ের পদ্ধতি চালু করেছেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কা’বের নেতৃত্বে।(বুখারী,হা:নং-২০১০) [যেহেতু রাসুল(সা:) এর পক্ষ থেকে তারাবীহ’র নামাজের কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না।]
শাইখ ইবনে তাইমিয়া(রা:) বলেন; কোন সাহাবী হজরত ওমর(রা:) এর এই পদ্ধতিকে(২০ রাকাআত) অস্বীকার করেননি।এমনকি ২০ রাকাআত ‘র উপর সাহাবীদের এজমা ছিল।
ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী বলেন, ২০ রাকা’ত নামাজের উপর সাহাবিদের এজমা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইবনে কুদামা বলেন, এটি এজমার মতো। ইমাম নববী,হাফেজ ইবনে আবদুল বর মালেকী, নাওয়াব ছিদ্দিক হাসান প্রমুখ হাদিস বিশারদগণ এটিকে এজমায়ে সাহাবা বলে
স্বীকার করেছেন।
উসুলে ফিকহের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এজমায়ে সাহাবা অস্বীকার কারিকে কাফের বলা হয় । উল্লেখ্য হযরত আবু বকর ছিদ্দিক(রা:) ‘র খেলাফতের উপর ও সাহাবীদের এজমা ছিল। তার খিলাফত অস্বীকারকারী কাফের হয়ে যায়।
(খ)ইবনে তাইমিয়া(রা:) তার প্রসিদ্ধ ফতোয়ার কিভাবে ২০ রাকা’ত তারাবীহ ও তিন রাকাআত বিতর নামাজ আদায় করা উত্তম বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন। তিনি কিতাবের ২৩ খন্ডের ১১২ পৃষ্ঠায় বলেন,
قد ثبت آن ابي ابن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان و يوتر بثلاث، فراي كثير من العلماء أن ذلك هو السنة لأنه أقامه بين المهاجرين والأنصار ولم ينكره منكر.(مجموع فتاوى ابن تيمية)
অর্থাৎ : প্রমাণিত হল যে, উবাই ইবনে কা’ব(রা:) মানুষদের নিয়ে রমজানে ২০রাকা’ত তারাবীহ’র নামাজ আদায় করতেন,এবং বিতরের নামাজ তিন রাকাআত পড়তেন। অধিকাংশ উলামা মনে করেন ইহাই সুন্নাত। কেননা তিনি মোহাজির ও আনসারি সাহাবিদের মাঝে ২০ রাকা’ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাতে কেউ ২০ রাকাআত তারাবীহ ও ৩ রাকাআত বিতর অস্বীকার করেননি।
তিনি আরও বলেন,
واستحب آخرون ؛تسعة وثلاثين ركعة، بناء علي انه عمل أهل المدينة القديم، وقال طائفة؛ ثبت في الصحيح عن عائشة رض ؛ أن النبي صلى الله عليه وسلم لم يكن يزيد في رمضان ولا غيره على ثلاث عشرة ركعة،، و اضطرب قوم في هذا الأصل، لما ظنوه من معارضة الحديث لما ثبت من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين .والصواب أن ذلك جميعه حسن
অর্থাৎ: অনেকই তারাবীহ ৩৯ রাকাআত মুস্তাহাব বলে মনে করেন।ইহা পুরাতন মদিনা বাসীদের আমল( ইমাম মালেক এর অভিমত)।অপর একদল বলেন, হজরত আয়েশা(রা:) থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত আছে যে, রাসুল(সা:) রমজান ও অপরাপর মাসে ১৩ রাকা’তের বেশি নামাজ আদায় করতেন না। এই মূলনীতির বিষয়ে অপর যে দল ভ্রমে আছে তারা মনে করেন যে, ইহা সেই হাদিসের বিরুদ্ধাচরণ যা খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত এবং মুসলমানদের আমল দ্বারা প্রমাণিত(২০ রাকা’ত)। তবে সঠিক মতামত হচ্ছে প্রত্যেক পদ্ধতিই হাসান বা উত্তম।
ইবনে তাইমিয়া আরো বলেন, তারাবীহ’র নামাজের সংখ্যা রাসুল(সা:) কর্তৃক নির্দিষ্ট নেই। তাই ;
ثم كان طائفة من السلف يقومون باربعين ركعة ويوترون بثلاث وأخرون قاموا بست وثلاثين واوتروا بثلاث؛ وهذا كله ساءغ فكيف ما قام في رمضان هن هذه الوجوه فقد احسن.
অর্থাৎ: সলফে সালেহিনের একটি দল তারাবীহ ৪০ রাকাত/ বিতর ৩ রাকাআত ; অপর দল ৩১রাকা’ত ও ৩ রাকা’ত আদায় করতেন।
এ সমস্ত প্রত্যেক পদ্ধতি শরীয়াসিদ্ধ।
রমজানে যে কোন একটি পদ্ধতিতে তারাবীহ আদায় করা অধিক উত্তম ।
(গ) ইবনে তাইমিয়া(রা:) উক্ত কিতাবের ২২ খন্ড: ২৭২ নং পৃষ্ঠায় নিজের অভিমত ব্যক্ত করে আরো বলেন;
فالقيام بعشرين ركعة هو الأفضل و هو الذي يعمل به أكثر المسلمين فإنه وسط بين العشر والأربعين.
অর্থাৎ: ২০ রাকা’ত তারাবীহ’র নামাজ আদায় করা, ইহা অবশ্যই সর্বাপেক্ষা উত্তম। এর উপরে অধিকাংশ মুসলমান আমল করে থাকেন। নিশ্চয় কেননা ইহা ১০ ও ৪০’র মধ্যে অবস্থান।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ইবনে তাইমিয়া(রা:)২০ রাকাআত তারাবীহ এবং ৩ রাকাআত বিতর নামাজ আদায়কেই উত্তম বলে স্বীকৃতি ও ফতোয়া প্রদান করেছেন।
(ঘ) যে সমস্ত হাদিস দ্বারা ৮ রাকাআত তারাবীহ প্রমাণিত হয় সে হাদিসের ব্যাখ্যায় জমহুর উলামাদের অভিমত নিম্নে উল্লেখ করা হল ;
১) উক্ত হাদিসে ৮ রাকাআত দ্বারা তাহাজ্জুদের নামাজ উদ্দেশ্য।হাদিসে لم يكن يزيد في رمضان ولا غيره বা রমজান ও রমজানের বাইরে এর চেয়ে বেশি পড়তেন না বলে উল্লেখ আছে।
কারণ, রমজান ছাড়া তারাবীহ পড়া হয় না। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা হয়। সেই ৮ রাকাআত রাতের শেষ দিকে রাসুল(সা:) আদায় করতেন।তারাবীহ রাতের শুরুতে আদায় হয়ে থাকে।
২)- ওমর(রা:) সুন্নাহ বিরোধী কোন কাজ করতে পারেননা।
৩)- কারণ, তিনি বিদআত বিরোধী কঠোর অবস্থান গ্রহন করতেন।
৩) কোন সাহাবী ২০ রাকাআত তারাবীহ’ র নামাজ আদায় অস্বীকার করেননি।
৫) রাসুল(সা:) এর পক্ষ থেকে ২০ রাকা’ত বিষয়ে কোন আমল/ কথা ছিল বলে ওমর(রা:) রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই আমল বাস্তবায়ন করেছিলেন। হয়ত তার সনদ আমাদের পর্যন্ত বিশুদ্ধভাবে পৌছেনি।
৬) হাফেজ ইবনে হাজর المطالب العالية গ্রন্থে একটি হাদিস উল্লেখ করেন যে,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر. ( مصنف ابن أبي شيبة و مسند عبد بن حميد)
অর্থাৎ: রাসুল(সা:) রমজানে ২০ রাকাআত তারাবীহ আদায় করতেন।
<আল্লামা ত্বকী উসমানি বলেন, আল্লামা বুসীরি উক্ত হাদিসের সনদ দুর্বল উল্লেখ করলেও ইজমা ও উম্মতের আমল এই হাদিসকে শক্তিশালী করেছে। সুতরাং এই হাদিসকে দুর্বল বলা যাবেনা।
৭) ইমাম আবু ইউসুফ(রা:) বলেন;
سألت أبا حنيفة عن التراويح و ما فعله عمر رض ؟ فقال التراويح سنة مؤكدة ولم يتحرضه عمر عن تلقاء نفسه و لم يكن فيه مبتدعا ولم يأمر به إلا عن أصل لديه و عهد من رسول الله صلى الله عليه وسلم ( مراقي الفلاح )
অর্থাৎ: আমি ইমাম আবু হানিফা(রা:) কে তারাবীহ ও ওমর(রা:) এর উক্ত কর্মের বিষয়ে প্রশ্ন করেছি। তিনি বলেন; তারাবী’র নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ওমর(রা) ইহা মনগড়া প্রবর্তন করেননি। বিদা’ত প্রচলন করেননি। দ্বীনের মূল বিষয় যা তার কাছে ছিল তা থেকে তিনি ২০ রাকা’ত এর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা তিনি রাসুল(সা:) এর কাছ থেকে আহরণ করেছিলেন।
(ঙ) খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের উপর আমল করা আমাদের জন্য আবশ্যক। ওমর(রা:) খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম। তার সুন্নাত মুসলমানদের পালন করা আবশ্যক। রাসুল(সা:) বলেন;
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين ( أبو داود، الترمذي)
অর্থাৎ: তোমরা আমার সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করবে( আবু দাউদ ও তিরমিযী)
(চ)পরিতাপের বিষয় হলো; অনেকে ইবনে তাইমিয়ার মতো বিদগ্ধ হাদিস বিশারদকে না বুঝে,তার কিতাব না পড়ে তার উপর মিথ্যারোপ করে থাকেন। তিনি নাকি তারাবী’র ২০রাকা’ত ও বিতরের ৩ রাকা’ত অস্বীকার করেন! অদ্ভুত!!
(ছ)এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইবনে তাইমিয়া/ অন্য কেউ যদি ২০ রাকাআত তারাবীহ কে অস্বীকার করেন। তখন সকল মুসলমানের ঈমানের দাবি হলো সেই মতবাদকে উপেক্ষা করা ।সেই ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে ঈমানী শক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা। কারণ ওমর(রা:)’র সুন্নাতের বিরুদ্ধে ইবনে তাইমিয়া কিংবা পরবর্তী কারো মতামত মূল্যহীন।
তবে ইবনে তাইমিয়ার মত একজন হাদিস বিশারদ এ রকম গর্হিত অপরাধ কোন দিন করতে পারেননা। তাই তিনি ২০ রাকা’ত তারাবীহ’র নামাজ ও ৩ রাকাআত বিরতের নামাজ আদায় করা উত্তম বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন।
সুতরাং ইবনে তাইমিয়া ওমর (রা:) এর সুন্নাত ২০ রাকা’ত এর উপর কোন ধরণের চুরি চালানোর ধৃষ্টতা প্রদর্শনের দু:সাহস দেখাননি। সুন্নতের অনুসারী হিসেবে ২০ রাকা’ত তারাবীহ’র নামাজকে জোর দিয়ে উত্তম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। বিতর নামাজ কে ৩ রাকাআত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
লেখক: অধ্যাপক আবদুল মান্নান বিএ(সম্মান)এমএ_এমএম_এলএলবি