প্রফেসর ড. আ ক ম আব্দুল কাদের
চীনের হুবাই প্রদেশের রাজধানী উহানে যখন করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে তখন আমি ছিলাম তুরস্কে। ফেব্রুয়ারী মাসের ২৩ তারিখে দেশে ফেরার পথে বিমান কর্তৃপক্ষ সকল যাত্রীর হাতে একটি করে ফরম ধরিয়ে দেয় যাতে অনেকগুলো কলাম ছিল। এইসব কলামের উল্লেখযোগ্য ছিল, বিমানের যাত্রী কোন দেশ থেকে কোন এয়ারলাইন্সে এসেছে, গত এক সপ্তাহে তার গায়ে কোন জ্বর কিংবা সর্দি- কাশি- কফ ইত্যাদি ছিল কিনা? আমি ফরম পূরণ করে বিমানবালার নিকট জমা দিতে চাইলে তারা বললো, এটা জমা দিতে হবে না। এইভাবে বিমান কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ে। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা।
এই বছর ১৭ মার্চ থেকে শুরু হলো দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন। এই লকডাউনে মাঝে মধ্যে অফিস- আদালত, কল- কারখানা, দোকানপাট ইত্যাদি খুলেছে, গাড়ি ঘোড়া চলেছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা একদিনের জন্যও খোলেনি। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাগুলো না নিয়ে কর্তৃপক্ষ আগের পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে অটো পাশ ঘোষণা করলেও সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উচ্চশিক্ষা। এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যে যেখানে ছিল সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম প্রথম কিছুদিন অনলাইনে এদের ক্লাস শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর কোন ফলাফল বয়ে আনতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় নি। ফলে আমাদের সন্তানদের জীবনে নেমে এসেছে হতাশার কালো ছায়া, আর তারা মানসিকভাবে হয়ে পড়েছে চরম হতাশাগ্রস্থ।
ইতোমধ্যে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। গতকাল ৫ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ২৬৪ জন। এই সংখ্যা এই যাব্ৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই করোনায় আমি নিজে অসংখ্য আপনজন, বন্ধু বান্ধব, ছাত্র, শিষ্য, সহকর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীকে হারিয়েছি। আর আক্রান্তের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সর্বাত্মক উদ্যোগের ফলে দেশে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আমিও ফেব্রুয়ারী এবং এপ্রিল মাসে পর পর দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছি। আর বাকীটা মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তাঁর কুদরতি হাতে সঁপে দিয়েছি।
গত ৬ জুলাই আমার বেয়াইন নোয়াখালীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আমার জামাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এম্বুলেন্স সহকারে নোয়াখালী চলে যায় এবং তাঁকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করায়। জামাই তার মায়ের সাথে হাসপাতালে অবস্থান করে সেবা যত্ন করার সৌভাগ্য অর্জন করে। আল হামদু লিল্লাহ! তিনি সুস্থ হয়ে গত ১৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসস্থ বাসায় তাদের বাসায় ফিরে আসেন।
এরি মধ্যে আমার মেয়ের সর্দি, কাশি, জ্বর ও খাবারের রুচিহীনতা দেখা দেয়। আমি এক অনূজকে ফোন দিলাম। সাথে সাথে মেডিকেল টিম যন্ত্রপাতি নিয়ে বাসায় এসে হাজির। তারা আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং জামাই- এর সেম্পল নিয়ে যায়। আমার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি। তাই সকলের পীড়াপীড়ি অগ্রাহ্য করে আমি নিজের সেম্পল দিতে রাজি হইনি। পরদিন ল্যাব থেকে শিষ্যরা ফোন করে জানিয়ে দিল, জামাই ছাড়া অন্য সকলের রিপোর্ট পজিটিভ। এই ক্ষেত্রে আমার সবচাইতে বেশী ভালো লেগেছে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ। যাদের পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে তাদের সকলকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে আমার মনে হয়।
এর পাশাপাশি দেশ- বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়- স্বজন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনেকেই বিষয়টি অবহিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। এতে আমাদের প্রতি তাঁরা কতটুকু আন্তরিক তা বুঝতে পেরেছি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণার কাজে আমি প্রায় প্রতিদিনই অফিসে যাতায়াত করছি শুনে তাঁদের কেউ কেউ ভীষণ উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন। একজন করোনা রোগী কীভাবে বাইরে বাইরে ঘুরতে পারে এটি ছিল তাঁদের জিজ্ঞাসা। অথচ আমার শরীরে করোনার কোন লক্ষণ না থাকার কারণে আমি টেস্ট করার জন্য সেম্পল পর্যন্ত দেইনি। আর সেম্পল না দেওয়ার কারণে আমি প্রতিনিয়ত পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভীষণ চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে অবশেষে গত ৩ আগস্ট নির্দিষ্ট জায়গায় আবার ফোন দিলাম। পরদিন ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় মেডিকেল টিম পুনরায় বাসায় এসে হাজির। সেম্পল নিয়ে গিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করার পর ৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাকে ল্যাব থেকে ফোন করে জানালো যে, ফলাফল নেগেটিভ। অথচ গত দুই সপ্তাহ ধরে আমি পরিবারের পক্ষ হতে যেই মানসিক চাপ সহ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে যে, সত্যি সত্যিই আমি একজন করোনা আক্রান্ত রোগী। এর মূল কারণ হলো করোনা ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তৃতি এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে আপনজনের মৃত্যুর সংবাদ। মূলত পবিত্র ঈদুল আযহার ছুটিতে শহর হতে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাড়ী ঘরে যাওয়ার ফলে এই ভাইরাস গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই করোনা ভাইরাস এখন আর শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই এই মুহূর্তে সবচাইতে বড় প্রয়োজন হলো সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস। এর পাশাপাশি সরকার কর্তৃক নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। আর কোন শারীরিক সমস্যা কিংবা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে কালবিলম্ব না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কোন অবস্থাতেই বিষয়টিকে হালকাভাবে না দেখা। আর সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করা যেন তিনি সবাইকে এই মহামারী থেকে হেফাজত করেন।